logo
গুলিতে নিহত শহীদ নাছিমা। ছবি : সংগৃহীত

সেদিন ছিল ১৯ জুলাই, শুক্রবার। সকাল থেকেই নীলক্ষেত মোড়, ঢাকা কলেজ, সায়েন্স ল্যাব মোড়সহ আশপাশের এলাকায় চলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং গোলাগুলি। পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেলে আশপাশের এলাকা ছিল অন্ধকার। এমনকি সায়েন্স ল্যাব মোড়ের আশপাশের বাসাগুলোতেও টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকেই। সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে একটানা ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও গোলাগুলি।

এ ছাড়া আন্দোলন চলাকালে হেলিকপ্টার থেকেও গুলি ছোড়া হয়। আর সেই গুলিতেই শহীদ হন নাছিমা আক্তার (২৪)।

ঘটনার দিন ১৯ জুলাই বিকেল ৫টার পরে পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়। তখন আশপাশের বাসার অনেকেই বাইরের পরিস্থিতি দেখার জন্য নিজ নিজ বাসার ছাদে যান। ছাদ থেকে চারপাশের ছবি তোলেন। ভিডিও করেন অনেকেই।

আশপাশের বাসার সবাইকে ছাদে যেতে দেখে দুই ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে গিয়েছিলেন নাছিমা আক্তার। কিন্তু এই ছাদে যাওয়াই যে নাছিমার কাল হবে তা কে জানত। ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে নাছিমা নোয়াখালী থেকে ভাইয়ের ধানমন্ডির বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন।

নাছিমা আক্তার ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন ২০ জুলাই বিকেলে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। পরে ২১ জুলাই সকাল ৮টার দিকে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মনপুরা গ্রামে তাকে দাফন করা হয়। নাছিমার সঙ্গে ছাদে গুলিবিদ্ধ হন তার ভাতিজা আইমান উদ্দিন (২০)।

নাছিমার ভাবি রেহানা আক্তার ওই দিনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, নাছিমা আমার দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বিকেল ৫টার দিকে ছাদে যায়। ওই সময়ে হেলিকপ্টার আমাদের এলাকায় চক্কর দিতে থাকে। সাড়ে ৫টার দিকে একটা গুলি ছেলের বুকের এক পাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে পেছনে থাকা নাছিমার গালের ভেতর দিয়ে গলার খাদ্যনালিতে ঢুকে যায়। আমাদের ধারণা হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে। কারণ সে সময়ে আশপাশের পরিবেশ শান্ত ছিল। আর নয়তলার ছাদে নিচ থেকে কীভাবে গুলি করবে?

রেহানা আক্তার আরও বলেন, আমি ওদের নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, ছাদে যাওয়ার দরকার নেই। তখন নাছিমা বলে, অনেক সময় হলো বাসায় বন্দি, ভালো লাগছে না। আমি ওদের নিয়ে ছাদে যাই। তখন আশপাশের বাসার অনেকেই ছাদে অবস্থান করছিল দেখে, আমিও আর কিছু বলি নাই।

রেহানার স্বামী হেলাল উদ্দিন স্পেনপ্রবাসী। তার পরিবার ধানমন্ডির ১ নম্বর রোডের একটি নয়তলা ভবনে ভাড়া থাকেন। ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে নাছিমা নোয়াখালী থেকে তার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। নাছিমা তার তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে সবার ছোট। বড় ভাই হেলাল উদ্দিন ও ছোট ভাই আরমান হোসেন থাকেন স্পেনে। আর মেজ ভাই আব্দুর রহমান থাকেন নোয়াখালীতে। মা সালেহা বেগম বেঁচে থাকলেও বাবা ইউসূফ আলী ২০০৩ সালে মারা গেছেন। তিন বোনের বিয়ে হলেও নাছিমা ছিলেন অবিবাহিত। তিনি বেগমগঞ্জের স্থানীয় মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। মা সালেহা বেগমের বয়স হওয়ার কারণে তাকে দেখাশোনা করতেন তিনি। নাছিমা মায়ের সঙ্গে নোয়াখালীর বাসাতেই থাকতেন।

সেদিন নাছিমার ভাতিজা আইমান উদ্দিন (২০) আহত হয়েছিলেন। তার বুকের ডান পাশে গুলি লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আইমান বলেন, ছাদে আমি, ছোট ভাই সাইমান উদ্দিন, ফুপি নাছিমা এবং অন্য ফ্ল্যাটের আরও কয়েকজন ছিলেন। হঠাৎ করেই একটি গুলি এসে আমার বুকের এক পাশে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে ফুপির গালে লাগে। গুলিবিদ্ধ হয়েই ফুপি ছাদে পড়ে যান।

তিনি বলেন, আমরা যখন ছাদে যাই তখন মাথার ওপর হেলিকপ্টার উড়ছিল। আমার ধারণা হেলিকপ্টার থেকে করা গুলি আমার ও ফুপির গায়ে লাগে। তখন আমার ছোট ভাই আমাকে ধরে লিফটে করে নিচে নামায়। পরে আমার আর কিছু মনে নেই।

আইমান উদ্দিনের মা রেহানা বলেন, ঘটনা শুনে আমি চিৎকার শুরু করি। আশপাশের বাসার মানুষ এসে আমার ছেলে ও ননদকে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যায়। সে সময়ে যে কি একটা অবস্থা ছিল, ইন্টারনেট ছিল না। কোথাও কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। ওদের হাসপাতালে নিতেও বাধা দেওয়া হয়েছিল। পরে আমার ছেলের চিকিৎসা শুরু হয়। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করে আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু ননদকে বাঁচাতে পারেননি। নাছিমা ২০ তারিখ বিকেলে মারা যায়। আয়মান ১৫ দিন চিকিৎসার পর ৫ আগস্ট বাসায় ফেরে।

কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি জানিয়ে নাছিমার বড় ভাবি রেহানা বলে- শুনেছি, যে সকল ফ্যামিলি থেকে শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে তাদের সরকার অনেক ধরনের সহযোগিতা করেছে। কিন্তু আমরা তো কিছু পাইলাম না। আমার ছেলের চিকিৎসা করাতে প্রায় ২২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ননদ তো মারাই গেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কেউ কোনো আর্থিক সহযোগিতা দেয় নাই। নিজেরা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নাছিমারে নোয়াখালী নিয়ে দাফন করছি।

ছোট মেয়ের এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না মা সাহেলা বেগম। তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমার ছেলেও মেয়ের মধ্যে নাছিমা ছিল সবার ছোট। ছোট দেখে নাছিমাকে সবাই অনেক আদর করতো। যেদিন ঘটনা ঘটে তার কিছুদিন আগে ঢাকায় ভাইয়ের বাসায় যায় নাছিমা। ভাবছিলাম মেয়েটারে বিয়ে দেব। কিন্তু আমার নির্দোষ মেয়েটারে মাইরা ফেলল। আমার বুক খালি কইরা দিল। আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই।

নাছিমার বড় বোনের স্বামী (দুলাভাই) অবসর প্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নুর উল্যাহ বলেন, ওকে আমি নিজের ছোট বোনের মত ভালোবাসতাম। নাছিমা সবার ছোট ছিল, তাই ওকে আমরা সবাই আদর করতাম। ওর মৃত্যু আমরা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

call: "+8801752255733", // Call phone number email: "masud84905@gmail.com", // Email link: "https://www.banglablogg.com", // Link